জগদীশ চন্দ্র বসু সম্পর্কে বক্তব্য | Speech on Jagadish Chandra Bose in Bengali
প্রিয় শিক্ষকবৃন্দ, সহপাঠীরা এবং প্রিয় বন্ধুরা, আজ আমি আপনাদের সামনে এক মহান ব্যক্তিত্বের কথা বলব, যার নাম জগদীশ চন্দ্র বসু। তিনি এমন একজন বিজ্ঞানী যিনি ভারতবর্ষকে বিশ্বমানচিত্রে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। আমরা প্রতিনিয়ত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যবহার করে জীবনের নানা সমস্যার সমাধান খুঁজি। তবে সেই সমস্ত অগ্রগতির পেছনে আছে এমন কিছু মানুষ, যাঁরা নিরলস পরিশ্রম এবং নিবিড় গবেষণার মাধ্যমে আমাদের আজকের উন্নত সমাজের ভিত্তি গড়ে তুলেছেন। জগদীশ চন্দ্র বসু এমনই একজন ব্যক্তিত্ব, যিনি উদ্ভাবনের মাধ্যমে বিজ্ঞান জগতকে সমৃদ্ধ করেছেন।
আজ আমি তাঁর জীবনী, অবদান এবং তিনি আমাদের জন্য কীভাবে অনুপ্রেরণা হতে পারেন, সে সম্পর্কে কিছু কথা বলব।
জন্ম ও শৈশবকাল:
জগদীশ চন্দ্র বসুর জন্ম হয়েছিল ১৮৫৮ সালের ৩০ নভেম্বর, বাংলাদেশের মুনশিগঞ্জ জেলার বিক্রমপুর গ্রামে। তাঁর পিতা ভগবান চন্দ্র বসু ছিলেন একজন শিক্ষানুরাগী এবং প্রশাসনিক কর্মকর্তা। ছোটবেলা থেকেই জগদীশ চন্দ্র প্রকৃতির প্রতি গভীর আগ্রহী ছিলেন। তাঁর পিতা তাঁকে স্থানীয় বাংলা মাধ্যম স্কুলে পড়াশোনা করান, যেখানে তিনি গ্রামের সাধারণ ছাত্রদের সাথে পড়াশোনা করেছেন। এখান থেকেই তাঁর মনে সাধারণ মানুষের জীবনের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জন্মায় এবং তিনি নিজের পড়াশোনা এবং গবেষণায় দেশ ও মানুষের উপকারে কিছু করতে উৎসাহী হয়ে ওঠেন।
শিক্ষাজীবন ও সংগ্রাম:
জগদীশ চন্দ্রের শিক্ষাজীবন সহজ ছিল না। প্রথমে কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে পড়াশোনা করেন এবং সেখান থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেন। পরে তিনি ইংল্যান্ডে গিয়ে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। সেখানে তাঁর পিতার আর্থিক সীমাবদ্ধতার কারণে তাঁকে অনেক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয়েছিল। তবে তাঁর অধ্যবসায় এবং জ্ঞানার্জনের প্রতি নিষ্ঠা তাঁকে কখনো দমাতে পারেনি। এই সময়েই তিনি বিখ্যাত বিজ্ঞানী লর্ড রেলির অধীনে গবেষণা শুরু করেন এবং পদার্থবিজ্ঞান এবং উদ্ভিদবিজ্ঞান নিয়ে গভীর গবেষণা করতে থাকেন।
উদ্ভিদবিজ্ঞান ও উদ্ভিদের অনুভূতি:
জগদীশ চন্দ্র বসু এমন একটি যুগান্তকারী আবিষ্কার করেন যা সারা বিশ্বকে অবাক করে দেয়। তিনি উদ্ভিদবিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা করে প্রমাণ করেন যে উদ্ভিদও জীবিত প্রাণীর মতো সাড়া দেয়। তাঁর উদ্ভাবিত যন্ত্র 'ক্রেসকোগ্রাফ' উদ্ভিদের বৃদ্ধি এবং প্রতিক্রিয়া নির্ধারণ করতে সাহায্য করে। এর মাধ্যমে তিনি দেখান যে উদ্ভিদও ব্যথা অনুভব করতে পারে এবং তাদের ওপর বহিরাগত চাপ প্রয়োগ করলে তারা তার প্রতিক্রিয়া জানায়। এই আবিষ্কার বিজ্ঞান জগতে এক নতুন যুগের সূচনা করে এবং তাঁর গবেষণা শুধু ভারতেই নয়, সারা বিশ্বে বিজ্ঞানীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
তাঁর এই আবিষ্কার আমাদের জানান দেয় যে প্রকৃতি শুধু মানুষের জন্য নয়, সকল জীবন্ত প্রাণী এবং উদ্ভিদের জন্যও সমান গুরুত্বপূর্ণ। তিনি পরিবেশ এবং প্রকৃতির সাথে মানুষের একাত্মতা এবং তার প্রতি দায়িত্ববোধকে জাগিয়ে তুলেছিলেন।
রেডিও বিজ্ঞানে অবদান:
জগদীশ চন্দ্র বসু শুধুমাত্র উদ্ভিদের গবেষণাতেই সীমাবদ্ধ ছিলেন না। তিনি রেডিও বিজ্ঞানেও অবিস্মরণীয় অবদান রেখেছেন। তিনি রেডিও তরঙ্গের মাধ্যমে বেতার যোগাযোগের ধারণা দিয়েছিলেন এবং রেডিও আবিষ্কারের মূল ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন। যদিও অনেক সময় রেডিও আবিষ্কারের কৃতিত্ব মারকনি পেয়েছেন, তবে প্রকৃতপক্ষে জগদীশ চন্দ্র বসুর গবেষণাই এই প্রযুক্তির জন্য মাইলফলক ছিল।
তাঁর গবেষণার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল বৈদ্যুতিক তরঙ্গ এবং রেডিও ফ্রিকোয়েন্সির ব্যবহার। তিনি প্রমাণ করেছিলেন যে রেডিও তরঙ্গ কঠিন বস্তুর ভেতর দিয়ে অতিক্রম করতে পারে, যা পরবর্তীতে রেডিও যোগাযোগ ব্যবস্থার ভিত্তি গড়ে তোলে। তবে জগদীশ চন্দ্র বসু কখনো নিজের আবিষ্কারের পেটেন্ট নেননি। তিনি বিশ্বাস করতেন বিজ্ঞান সার্বজনীন এবং তা সকলের জন্য উন্মুক্ত থাকা উচিত।
ব্যক্তিগত জীবন ও মূল্যবোধ:
জগদীশ চন্দ্র বসু একজন সহজ সরল মানুষ ছিলেন। তিনি সবসময় বিজ্ঞানকে মানব কল্যাণে ব্যবহার করার কথা বলতেন। তাঁর জীবনের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল তাঁর সমাজের প্রতি দায়িত্ববোধ। তিনি তাঁর সমস্ত গবেষণা, উদ্ভাবন এবং আবিষ্কারকে মানুষের কল্যাণে উৎসর্গ করেছেন। তিনি বলেন, "বিজ্ঞান হচ্ছে মানবতার জন্য এক মহান আশীর্বাদ। আমাদের উচিত বিজ্ঞানকে মানুষের সেবায় ব্যবহার করা।"
তাঁর জীবনের এই মূল্যবোধ আমাদেরও শিক্ষা দেয় যে আমরা যা কিছু করি, তা মানবতার উপকারে লাগতে হবে। বিজ্ঞান শুধুমাত্র গবেষণার জন্য নয়, এটি মানুষের জীবনে পরিবর্তন আনতে এবং উন্নতি ঘটাতে সাহায্য করতে পারে।
বিজ্ঞান ও মানবতায় অবদান:
জগদীশ চন্দ্র বসুর বিজ্ঞান এবং মানবতার প্রতি অবদান আজও স্মরণীয়। তাঁর উদ্ভাবন এবং আবিষ্কার শুধু প্রযুক্তিগত উন্নতির জন্য নয়, মানবতার কল্যাণেও সমান গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তিনি প্রমাণ করেছেন যে শিক্ষা, অধ্যবসায় এবং নিষ্ঠা দিয়ে মানুষ সব কিছু অর্জন করতে পারে।
তাঁর উদ্ভাবনী চিন্তা এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণা ভারতকে বিশ্ববিজ্ঞানের অগ্রগামী অবস্থানে নিয়ে গেছে। ভারতীয়দের মধ্যে বিজ্ঞানচর্চার আগ্রহ বৃদ্ধিতে তাঁর অবদান অসামান্য। তিনি দেখিয়েছেন কীভাবে বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি মানবতার উন্নয়নে ব্যবহার করা যেতে পারে এবং আমাদের দেশকে উন্নতির পথে নিয়ে যাওয়া যেতে পারে।
উপসংহার:
জগদীশ চন্দ্র বসু আমাদের জীবনের এক মহান অনুপ্রেরণা। তাঁর জীবন, শিক্ষা, গবেষণা এবং মানবতাবাদী মূল্যবোধ আমাদেরকে অনুপ্রাণিত করে। তিনি দেখিয়ে গেছেন কীভাবে কঠোর পরিশ্রম এবং অটুট মনোবল নিয়ে বড় বড় স্বপ্ন পূরণ করা যায়। তাঁর উদ্ভাবনী মনোভাব এবং সমাজের প্রতি তাঁর দায়িত্ববোধ আমাদের সকলকে শিক্ষা দেয়।
তাঁর জীবনের গল্প আমাদের শেখায় যে বিজ্ঞান শুধুমাত্র তত্ত্ব নয়, এটি একটি জীবনযাত্রা, যা মানবতার কল্যাণে ব্যবহার করা উচিত। আমাদের সকলের উচিত তাঁর পথ অনুসরণ করা এবং বিজ্ঞান ও মানবতার জন্য কাজ করা।
আপনাদের ধন্যবাদ।
আরও পড়ুন
- সত্যজিৎ রায় র উপর বক্তৃতা, সংক্ষিপ্ত জীবনী
- শেখ মুজিবুর রহমানের উপর বক্তৃতা, সংক্ষিপ্ত জীবনী
- জগদীশ চন্দ্র বসু সম্পর্কে বক্তব্য, সংক্ষিপ্ত জীবনী
- রামমোহন রায়ের উপর বক্তৃতা, সংক্ষিপ্ত জীবনী
- রবী শঙ্কর সম্পর্কে বক্তব্য, সংক্ষিপ্ত জীবনী
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ওপর বক্তৃতা, সংক্ষিপ্ত জীবনী
- স্বামী বিবেকানন্দ সম্পর্কে ভাষণ, সংক্ষিপ্ত জীবনী
- আমর্ত্য সেনের উপর বক্তৃতা, ভাষণ, সংক্ষিপ্ত জীবনী
- ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর নিয়ে বক্তব্য, ভাষণ, সংক্ষিপ্ত জীবনী