রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ওপর বক্তৃতা | Speech on Rabindranath Tagore in Bengali

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ওপর বক্তৃতা | Speech on Rabindranath Tagore in Bengali

সুপ্রিয় শিক্ষক, সম্মানিত বিচারকবৃন্দ, এবং আমার প্রিয় বন্ধুগণ,

আমি আজ আপনাদের সামনে ভারতের গর্ব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ওপর একটি বক্তৃতা দিতে এসেছি। তাঁর জীবন ও সৃষ্টিকর্ম আমাদের কাছে চিরকাল অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে। আশা করি, আমার চিন্তাগুলো আপনাদের কাছে পৌঁছাতে সক্ষম হব।

Speech on Rabindranath Tagore in Bengali

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবন ও শৈশব

১৮৬১ সালের ৭ মে, কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তিনি ছিলেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও সারদা দেবীর পুত্র। ছোটবেলায় বিভিন্ন স্কুলে পড়াশোনা করলেও প্রথাগত শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতি তার তেমন আগ্রহ ছিল না। প্রকৃতির সান্নিধ্যে বেড়ে ওঠার মধ্য দিয়েই তিনি জীবনের গভীরতা ও সৌন্দর্য উপলব্ধি করেন। তিনি একবার বলেছিলেন, "প্রকৃতিই আমার শিক্ষক" – এই প্রকৃতি থেকেই তিনি জীবনের নানা শিক্ষা ও অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন, যা পরবর্তীকালে তার সৃষ্টিতে গভীর প্রভাব ফেলেছিল।

সাহিত্য জগতে অবদান

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্যকর্ম আমাদের কাছে এক অনন্ত সাগর। তাঁর বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ গীতাঞ্জলি তাঁকে আন্তর্জাতিক খ্যাতি এনে দেয় এবং ১৯১৩ সালে এই গ্রন্থের জন্য তিনি নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। এর মাধ্যমে তিনি প্রথম অ-ইউরোপীয় ব্যক্তি হিসেবে নোবেল বিজয়ী হন। গীতাঞ্জলির প্রতিটি কবিতা যেন একটি জীবনের বাণী, যেখানে আধ্যাত্মিকতা ও মানবতার প্রতি গভীর ভালোবাসা ফুটে উঠেছে। এই সংগ্রহের কবিতাগুলো শুধুমাত্র ভারত নয়, সমগ্র বিশ্ববাসীকে মন্ত্রমুগ্ধ করেছে।

সামাজিক ও রাজনৈতিক চিন্তাধারা

রবীন্দ্রনাথ ছিলেন একজন মানবতাবাদী ও চিন্তাবিদ। তিনটি বড়ো আন্দোলন তাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল – ধর্মীয় পুনর্জাগরণ, যা রাজা রামমোহন রায় শুরু করেছিলেন; সাহিত্যিক আন্দোলন, যা বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়েছিল; এবং ভারতীয় জাতীয় আন্দোলন। তিনি এই আন্দোলনগুলোর মূল শিক্ষা গ্রহণ করে, তার রচনায় মানবতার মঙ্গল এবং শান্তির বার্তা পৌঁছে দিতে সচেষ্ট হন। তবে, তিনি রাজনৈতিক আন্দোলনের চেয়ে মনুষ্যত্বের পুনর্জাগরণে বেশি মনোযোগী ছিলেন এবং তাঁর বিশ্বাস ছিল যে, প্রকৃত স্বাধীনতা মানুষের মনের ভিতরেই নিহিত।

বিশ্বভারতীর প্রতিষ্ঠাতা

শিক্ষার গুরুত্ব উপলব্ধি করে তিনি ১৯২১ সালে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। এই প্রতিষ্ঠান ছিল তাঁর স্বপ্নের ফসল – যেখানে পূর্ব ও পশ্চিমের শিক্ষার মেলবন্ধন ঘটবে। তাঁর মতে, শিক্ষা মানে কেবলমাত্র পঠন-পাঠন নয়, বরং শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হল মানুষের মানবিক ও সামাজিক গুণাবলিকে জাগ্রত করা। এই শিক্ষা কেন্দ্রের মাধ্যমে তিনি সেই স্বপ্ন বাস্তবায়িত করার চেষ্টা করেছিলেন। বিশ্বভারতীর শিক্ষাব্যবস্থা সেই সময়ের প্রচলিত শিক্ষা পদ্ধতির বিপরীতে গিয়ে প্রকৃতি ও শিল্পকলাকে শিক্ষার অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে গ্রহণ করে।

সংগীত এবং কাব্যের অপূর্ব সংমিশ্রণ

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান এবং কাব্য আমাদের জাতীয় সম্পদ। তিনি প্রায় দুই হাজারেরও বেশি গান রচনা করেছেন, যা আমরা রবীন্দ্রসঙ্গীত নামে চিনি। তার রচিত গানগুলিতে প্রকৃতি, প্রেম, মানবতা, দেশপ্রেম, এবং আত্মিক মুক্তির প্রতিফলন ঘটে। তিনি ভারতের জাতীয় সঙ্গীত ‘জন গণ মন’ এবং বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত ‘আমার সোনার বাংলা’ রচনা করেন। এই গানগুলিতে তাঁর দেশপ্রেম এবং মানবতার প্রতি তার অগাধ ভালোবাসার পরিচয় মেলে। তাঁর গান এবং কবিতাগুলি প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে গভীরভাবে স্থান করে নিয়েছে এবং আমাদের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে আছে।

জীবনের দর্শন এবং সার্বজনীনতা

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সর্বদা সার্বজনীনতার ধারণায় বিশ্বাস করতেন। তিনি মনে করতেন যে ধর্ম, জাতি, এবং বর্ণের উর্ধ্বে উঠে মানুষের প্রতি ভালোবাসা এবং মানবতার জন্য কাজ করা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর লেখাগুলি মানবতার উদারতা, সহমর্মিতা, এবং শান্তির বার্তা প্রদান করে। তিনি বারবার বলেছেন, "জীবন যদি একদিকে না বাঁধি তবে জীবন অনেক বড় হয়ে ওঠে।" তাঁর এই ভাবনা আমাদের শিক্ষা দেয় যে মানুষের জীবন কেবল নিজের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং তা অন্যদের জন্যও উন্মুক্ত করা উচিত।

রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিতে প্রকৃতি

প্রকৃতির প্রতি রবীন্দ্রনাথের অনুরাগ ছিল অপরিসীম। তাঁর বেশিরভাগ রচনাতেই প্রকৃতির উপস্থিতি লক্ষণীয়। "আমার ছোটবেলার প্রথম পাঠশালা ছিল প্রকৃতি," এই কথাটি তিনি নিজেই একবার বলেছিলেন। প্রকৃতির সৌন্দর্য, ঋতুবদলের সংগীত, বৃক্ষের সতেজতা এবং মেঘের খেলায় তিনি সবসময় মুগ্ধ হতেন এবং তার রচনায় এই প্রকৃতির প্রভাব গভীরভাবে ফুটে উঠেছে। তাঁর রচিত 'সোনার তরী', 'মণিমালা', এবং 'চিত্রা'য় প্রকৃতির মুগ্ধতা স্পষ্টভাবে অনুভূত হয়।

উপসংহার

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শুধু বাঙালির নয়, সমগ্র বিশ্বের সম্পদ। তাঁর জীবন এবং কাজ আমাদের শিক্ষা দেয় কীভাবে আমরা মানবতাকে ভালোবাসতে পারি এবং সৃষ্টিশীলতাকে ব্যবহার করে সমাজের উন্নতিতে অবদান রাখতে পারি। তাঁর জীবন ও কাজ আমাদের জন্য এক অনন্ত অনুপ্রেরণার উৎস, যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে আমাদের পথ দেখিয়ে যাবে।

ধন্যবাদ।

আরও পড়ুন

Please validate the captcha.

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন